• সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:০২ পূর্বাহ্ন

অর্থনীতিতে সম্ভাবনার হাতছানি কলাপাড়ায় বছরে ৬ কোটি টাকার গোলের গুরু উৎপাদন হয়

নয়নাভিরাম গাইন (নয়ন) কলাপাড়া।। / ৭৮
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

গোলের গুড় (মিঠা) শুনতে অবাক লাগলেও অবাস্তব নয়। এমনই এক  সুস্বাদু ও স্বাস্থ্য সম্মত গুড় উৎপাদন করছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ৩’শত পরিবার। এরা পেশায় গুড় চাষী না হয়েও  গোল গাছ থেকে উৎপাদিত গুড় বিক্রি করে বছরে আয় করছেন প্রায় ৬ কোটি টাকা। এক সময়ের অবহেলিত নোনা পানির গোল গাছ এখন এ উপজেলার অর্থকরি ফসল। গোলের গুড়ের সুনাম  ছড়িয়ে পরেছে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে। বিক্রি হচ্ছে সুপার সপ,অনলাইন ও বিভিন্ন বানিজ্য মেলায়। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ভবিষ্যতে এর উৎপাদন, রক্ষনাবেক্ষন ও বিপনন বাড়ানোগেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ গুড় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।

গোল গাছ সুন্দর বনের ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদ। এটির নাম গোল গাছ হলেও আসলে এটি গোল নয়। এর গোড়ার দিকটা গুচ্ছাআকৃতির উপরে লম্বাটে নারকেল পাতার মতো। ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদ তাই এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা লবনাক্ত জমিতে। সুন্দরবনের স্বল্প ও মধ্যম লবণাক্ত অঞ্চলে এ গাছ জন্মে। এর পাতা প্রায় ৩-৯ মিটার লম্বা হয়। এছাড়াও ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের উপকূলীয় এবং মোহনা এলাকার একপ্রকার পাম জাতীয় উদ্ভিদ, যাদেরকে ‘নিপা পাম’ নামেও ডাকা হয়। বহু আগে উপকূলীয় অঞ্চলে কোন বেরিবাঁধ ছিল না যে কারণে সমুদ্র থেকে নদী ও শাখা খালে অবাধে লবণ পানি প্রবেশ করত। ওই সময় থেকেই পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী উপকূলীয় জেলাগুলোর বহু উপজেলায় খালের কিনার ও নদীর তীরে লবনাক্ত জমিতে প্রাকৃতিক ভাবে গোল বাগান সৃষ্টি হয়েছে। এটি পাম গোত্রীয় বলে এতে পাম ফলের মতো থোকা আকৃতির এক প্রকারের ফল হয়। স্থানীয় ভাষায় যাকে গাবনা বলে। এই গাবনার কান্ড এক কোপে কেটে তা বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করাহয়। এরপর প্রতিদিন বিকেলে ধারালো দা দিয়ে কান্ডের দু পাশ কেটে এর সাথে প্লাস্টিকের কৌটা অথবা মাটির ঘট বেধে দেয়া হয়। রোজ একটি ছড়া থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম রস পাওয়া য়ায়। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার খাল ও নদীর কিনারে লবণাক্ত জমিতে এই গোল গাছের দেখা মেলে। এক সময় এ গোল গাছ অবহেলীত থাকলেও বর্তমানে এটি সোনার ফসল।

সরেজমিনে গিয়ে দেখাযায় শীতের সকালে উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠানে উঠানে চলে গোলের গুড় তৈরীর কর্মযজ্ঞ। বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোরে গাছিরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। এরপর মাটির তৈরী চুলায় টিনের বড়পাত্রে জাল দিয়ে এ গুর তৈরী করে। পুরুষের পাশাপাশি এ কাজে সহযোগিতা করে বাড়ির নারী ও শিশুরা।

নবীপুর গ্রামে বাড়ির উঠানে গুড় প্রস্তুতে ব্যাস্ত গৃহিনী নিপুরানী,বিথীরানী,বাপ্পী রানী,ও মিনতি রানীর সাথে কথা হলে তারা জানান,অগ্রহায়ন মাসের মাঝামঝি থকে চৈত্রমাস পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ১১/১২ টা আবার বিকেল২/৩ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত দুই ধাপে তারা রস আগুনে জাল দিয়ে গুড় প্রস্তুত করেন। তবে এ কাজে তাদের প্রচুর লাকড়ি পুরতে হয়। এই লাকড়ি গোল বাগান,ধানের খড়,ও পার্শ্ববর্তী জংগল থেকে সংগ্রহ করেন। আবার অনেকে কিনে আনেন। তাদের গুড় প্রস্তুতে লাকড়ি  কিনতেই যা খরচ। এছাড়া বাড়তি কোন খরচ নাই।

মিনতি রানী বলেন,লাকড়িতে জাল দিয়ে গুড় তৈরী করেন তিনি সহ নবীপুর গ্রামের  সকলে। কিন্তু গুড়ের্র মান ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। কারন জাল দেওয়ার সময় গুরে আগুনের ছাই পরে আবার অনেক সময় ধোঁয়ার ঘ্রান আসে। তাই গুর প্রস্তুত করতে সরকারি সহায়তার মাধ্যমে আধুনিক চুলা বা বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।

গুড়চাষিরা জানান,গোলের রস বেশ মিষ্টিও সুস্বাদু তাই এ রস কাচা খান অনেকে। তাছাড়াও অনেকেই আবার বাড়িতে আতপ চাল দিয়ে রসের পায়েস ও পিঠা রান্না করে খায়।

স্থানীয় বাজারে এ গুরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গুড় বিক্রেতা নির্মল গাইন বলেন,গোলের গুরে কিছুটা লবনাক্ত থাকায় এ গুর ডায়াবেটিস রোগী সহ অন্যান্য যে কেউ খেতে পারেন। এ কারনেই এর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি মনে করেন। বাজারে গুর কিনতে আসা ক্রেতা নীলগঞ্জের কৃষক আমিনুল ইসলাম জানান,গোলের গুড় সুস্বাদু ও মজুদ করার ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী তাই প্রতিবছর তিনি এ গুড় খাওয়ার জন্য কিনে মজুদ করে রাখেন।

নবীপুর গ্রামের গুর চাষী মনোচ শিকারী জানান,তারা অগ্রহায়ণ মাসের ১৫ তাং থেকে চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন মাস এ গুর উৎপাদন করেন। এ বছর তার বাগানে গুর তৈরী উপোযোগী ২’শত ছড়া গাবনা (গোলের ফল) হয়েছে। তা থেকে তিনি প্রতিদিন ৫ কলস রস পান এ থেকে গড়ে ১৫ কেজি গুড় উৎপাদন করতে পারেন। প্রতি কেজি গুড় ২০০ টাকা দরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। এতে তিনি বছরে অন্তত ২৫০০০০ টাকা বিক্রি করেন। মাত্র ১ একর জমিতে ১ বছরে এ পরিমাণ অর্থ সে আয় করেন। গোলগাছে ভালো লাভবান হয়ে আন্দার মানিক নদীর কিনারে ২ একর জমিতে গোল বাগান করার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। সেখানে তিনি অন্তত ৫০০০ চারা রোপণ করবেন। এ বাগান থেকে ৩ বছরে সে বাণিজ্যিকভাবে গুড় উৎপাদন করতে পারবে।

আরেক চাষি সমীর সাধু বলেন,গত বছর তিনি পুরো গুর মৌসুমে প্রায় ১০ মণএর অধিক গুর উৎপাদন করেছে। তার সিংহভাগ গুর মোবাইলের অর্ডারে দুর দূরান্তে বিক্রি করছেন। এটাই এখন তার আয়ের প্রধান মাধ্যম। তিনি আরও জানান,আমাদের ১ বিঘা বা ৩০ শতাংশ জমিতে এক বছরে যে ধান উৎপাদন হয়। তাতে খরচ বাদ দিয়ে যা লাভ হয়,এর অন্তত ১০ গুন লাভ হয় ঐ পরিমান জমিতে গোল বাগান থাকলে। তবে রক্ষনাবেক্ষনের অভাব ও খাল ভরাট হওয়ায় ঐতিহ্য বাহী এ অর্থকরী ফসল গোলবাগান ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাই এ বাগান রক্ষায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ বলে তিনি মনে করেন। এছাড়াও ধানের জমির পাশাপাশি  খালের কিনারে,নদীর চড় বা পতিত জমিতে গোল বাগান করলে কৃষক উভয় দিকে লাভবান হতে পারেন বলে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ব্যক্তি উদ্যোগেও এবছর গোল বাগান করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।

উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে দেশের যে সকল জায়গায় বানিজ্যিক ভাবে গোলের গুর উৎপাদন হয় তার মধ্যে কলাপাড়া উপজেলা অন্যতম। এ উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে সবচেয়ে বেশি গোল গাছ থেকে গুর উৎপাদন হয়। এছাড়াও একই ইউনিয়নের নেয়ামতপুর,ইসলামপুর,গামইরতলা,হাজিপুর গ্রামে গুর উৎপাদন হয়। তাছাড়াও উপজেলার চাকামইয়া মিঠাগঞ্জ, ডালবুগঞ্জ,টিয়াখালী,সহ মোট ৮ টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ১ লক্ষাধিক গোলগাছ রয়েছে যা থেকে প্রায় ৩০০ মেট্রিকটন গুর উৎপাদন হয়। দুইশত টাকা  কেজি দরে যার বর্তমান বাজার মুল্য ৬ কোটি টাকা কোন ধরনের পরিচর্যা ও বিনিয়োগ ছাড়াই এ গোল বাগান থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা দেশের অর্থনিতীতে যুক্ত হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনিতী যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে। তেমনি স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে বহু পরিবার। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় গোলের বাগান কমে যাওয়ায় অস্তিত্ব সংকটে পরেছে অর্থকড়ি এ ফসল। তাই সরকারিভাবে নদীর পাড়, খালের কিনারে গোল বাগান করার পরামর্শ চাষিদের।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আরাফাত হোসেন জানান, দেশের মধ্যে বানিজ্যিক ভাবে যে কটি উপজেলায় গোলের গুর উৎপাদন হয় তার মধ্যে কলাপাড়া উপজেলা অন্যতম। এ উপজেলায় লক্ষাধিক গোল গাছ আছে। যা থেকে  চাষিরা বছরে প্রায় ৩ ‘শত মেট্রিক টন গুরু উৎপাদন করে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। তাই আমরা এ চাষকে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করতে চাই। গোলের গুড় জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে আমরা কৃষি বিভাগ আবেদন পাঠিয়েছি। এছাড়াও বি এস টি আই অনুমোদনের জন্য দরখাস্ত দিয়েছি। তিনি আরও জানান,ইতি পূর্বেই গোল চাষীদের কৃষি বিপণন অঙ্গে এসিসি প্রকল্পের আওতায় গুরের উৎপাদন এবং বোতলজাতকরণে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আশা করছি এর মাধ্যমে গোলের গুরের উৎপাদন বাড়বে এবং সরকারি পর্যায়ে আমরা সবসময় তাদের পাশে থাকব।

উপজেলা বন কর্মকর্তা মো.মনিরুল হক জানান, উপজেলায় যেসব গোলবাগান থেকে গুরু উৎপাদন হয় তা বেশিরভাগই ব্যক্তি মালিকানায় তাই আমাদের কাছে এর কোন হিসেব নেই। সরকারি ভাবে এবছর কলাপাড়া উপজেলায় কোন গোলবাগান করার পরিকল্পনা নেই বলেও তিনি নিশ্চিত করেছেন।


এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ
tawhidit.top/